এই অধ্যায়ে আমরা বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন গঠন ও রুপান্তরের ইতিহাস অনুসন্ধান করে কিছু যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করব।
বাংলা অঞ্চলের মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় গতিপথ আমরা কিছুটা অনুসন্ধান করেছি। সেখানে আমরা দেখেছি, স্থান ও কাল ভেদে মানুষ নানান বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতা নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতি গঠন করেছে। হাজার বছরের ইতিহাসে সামাজিক রীতি-নীতি, প্রথা-পদ্ধতি আর সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। আবার অনেক উপাদান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে। এর ফলে সমাজের গঠন প্রক্রিয়ায় এসেছে নানান পরিবর্তন ও বিবর্তন। তৈরি হয়েছে নানান ধরনের বৈচিত্র্য ও বহুত্ব। এই যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হয় তার ফলে সেই সমাজের মানুষের অবস্থান এবং ভূমিকাতেও আসে নানান পরিবর্তন।
চলো, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা এবং পূর্ববর্তী পাঠের আলোকে দু'টি ভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন ধারার সমাজে একজন ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা কেমন হতে পারে, সেই বিষয়ে একটি আলোচনা করি। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এই আলোচনা পর্বটি আমরা কার্যকর করতে পারি।
আলোচনার শেষে নিচের ছকটি পূরণ করি-
শিকার ও সংগ্রহ যুগে একজন মানুষ কীভাবে জীবন যাপন করত? | ২০২৪ সালে যেকোনো শহরে বসবাস করে এমন একজন মানুষ কীভাবে জীবন যাপন করছে? |
|
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় সমাজ ও সংস্কৃতি
মিশরীয় সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর অন্যতম। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর- পূর্বদিকে নীল নদের তীরে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সভ্যতাটির উদ্ভব হয়। প্রাচীন নগরভিত্তিক সমাজ কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখা গিয়েছিল মিশরীয় সমাজব্যবস্থায়।
মিশরীয় সমাজে মানুষ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। উচ্চ শ্রেণিতে অবস্থান করত- ফারাও বা শাসকগণ, অভিজাত অমাত্যগণ, পুরোহিত, বিত্তবান ভূমিমালিকেরা। দ্বিতীয় শেণিতে অবস্থান করত- বণিক, কারিগর, শ্রমশিল্পীসহ বিভিন্ন স্বাধীন পেশার মানুষেরা। যে কৃষিকে কেন্দ্র করে সভ্যতার অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছিল, সেই কৃষকেরা ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। মিশরে অধিকাংশ কৃষকের নিজের জমি ছিল না। কৃষকেরা তাই ভূমিদাস হিসেবে বিত্তবান ভূমি-মালিকদের জমিতে কাজ করতে বাধ্য থাকতেন। প্রাচীন মিশরীয় সমাজের সকল সুবিধা ভোগ করতেন রাজা, পুরোহিত এবং অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা। রাজাকে সেখানে বলা হতো ফারাও। সমাজ ব্যবস্থার একেবারে উপরে অবস্থান করতেন ফারাওগণ।
মিশরীয়দের প্রাচীন ইতিহাসে সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল পরিবার। পারিবারিক সম্পত্তির ওপর মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত ছিল। নারীদের সামাজিক মর্যাদা ছিল খুবই উঁচু অবস্থানে। মিশরের রাণীকে দেবতার স্ত্রী, মা, • কন্যা বলে বিবেচনা করা হতো। রাজবংশের মেয়েরাও সিংহাসনের দাবিদার ছিল এবং অনেকেই সিংহাসনে - অধিষ্ঠিতও হতো। মিশরের একজন রাণীর নাম হচ্ছে নেফারতিতি। তিনি ছিলেন রাজা আখেনাতেনের স্ত্রী।
প্রাচীন মিশরেই প্রথম সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে নারীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজেও নারীরা অংশ নিতেন। মিশরের রাজা আখেনাতেনের স্ত্রী রাণী নেফারতিতি ছিলেন তেমনই একজন প্রভাবশালী নারী। রাজা আখেনাতেন এবং তাঁর স্ত্রী নেফারতিতি মিশরীয়দের জীবনযাপনে বড়ো পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম ছবিতে রানী নেফারতিতির ভাস্কর্য এবং দ্বিতীয় ছবিতে শিল্পীর কল্পনায় নেফারতিতির চেহারার পুনর্গঠিত চিত্র।
সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মিশরীয়দের অত্যন্ত উজ্জ্বল ও বহুবিচিত্র অবদানের নজির পাওয়া যায়। মিশরীয়দের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর ধর্মের প্রভাব ছিল প্রবল। তারা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক শক্তি (যেমন: সূর্য, চন্দ্র, ঝড়, প্লাবন, বাতাস প্রভৃতি) এবং পশুপাখির (যেমন: সিংহ, বাঘ, সাপ, বাজপাখি, কুমির, বিড়াল প্রভৃতি) পূজা করত। মিশরীয় প্রধান দেবতা ছিল সূর্য দেবতা। সূর্য দেবতার নাম ছিল 'আমান রে'।
মিশরের শাসকদের উপাধি ছিল ফারাও। শাসক এবং পুরোহিতেরা মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছিল যে, ফারাওগণ দেবতাঁদের বংশধর। পরকালেও ফারাওগণ শাসকের মর্যাদা ফিরে পাবে। মৃত্যুর পর ফারাওদের দেহ যাতে পচে নষ্ট না হয়ে যায় সেই জন্য বিশেষ কায়দায় তাঁদের দেহ মমি করা হতো। পিরামিড নামে এক ধরনের অতিকায় স্থাপনার মধ্যে এসবমমি রাখা হতো। মমিকরণ প্রক্রিয়া এবং পিরামিড নির্মাণ কৌশলে মিশরীয়দের স্থাপত্যশৈলী এবং শরীরবিদ্যা সম্পর্কে উন্নত জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।
মৃতদেহকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রুপান্তর, পরিবর্তন, রাসায়নিক ব্যবহার করে কাপড়ের পরতে পরতে আবৃত করে কয়েকটি ধাপে অনেক সময় ধরে মমিতে পরিণত করা হতো। উপরের ছবিতে তেমনই কয়েকটি ধাপ গবেষণার মাধ্যমে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলায় মিশরীয় সভ্যতা প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল। কৃষির ওপর ভিত্তি করেই মিশরীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। নীল নদের বন্যা, খরা প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে আকাশের নক্ষত্ররাজির সম্পর্ক লক্ষ করেই তারা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় মনোনিবেশ করেছিল। কৃষি এবং ধর্মীয় প্রয়োজন থেকে তারা চন্দ্রপঞ্জিকার উদ্ভাবন করেছিল। আকাশে চন্দ্রের অবস্থান নিরীক্ষণ করে রচিত হয়েছিল চন্দ্রপঞ্জিকা। এই পঞ্জিকা অনুসারে বছরে তাঁদের দিনের সংখ্যা ছিল ৩৫৪টি। আনুমানিক ৪২০০ সাধারণ পূর্বাব্দের দিকে মিশরীয়রা সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করে ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করে সৌর পঞ্জিকা তৈরি করে। ৩০ দিনে ১ মাস, ১২ মাসে বছরের হিসাব মিশরীয়রাই প্রথম আবিষ্কার করেছিল। শুধু তাই নয়, নীলনদের বন্যার সঙ্গে বছরের হিসাবে মিলাতে গিয়ে তাঁরাই প্রথম 'লিপ ইয়ার' আবিষ্কার করে প্রতি চার বছর পরপর ৩৬৬ দিনে বছর গণনার রীতি চালু করে। দিনের বিভিন্ন সময় নিরূপণের জন্য তারা একধরনের সূর্যঘড়ি আবিষ্কার করেছিল।
গণিতের ক্ষেত্রেও তাঁদের অবদান ছিল অনেক। যোগ, বিয়োগ, গুণ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিল তারা। জ্যামিতিক হিসাব ও নকশা মিলিয়ে নির্মাণ করেছিল সে যুগের শ্রেষ্ঠতম বেশকিছু স্থাপত্যকীর্তি। এসব কীর্তি ইতিহাসের এক বিশেষ কালে নির্দিষ্ট একভূখণ্ডে একদল মানুষের জীবন-সংগ্রাম আর সভ্যতা রচনার অভিজ্ঞতাকে আজও ধারণ করে আছে।
ইতিহাসে মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম বড়ো অবদান হচ্ছে লিপির আবিষ্কার। মানুষের ইতিহাসে তাঁরাই প্রথম লিপির উদ্ভাবন করে। প্রথম দিকে তাঁদের লিপি ছিল চিত্রভিত্তিক। কোনো একটি বস্তুর নাম ও সংখ্যা লিখে রাখার জন্য তারা সে বস্তুটির চিত্র আঁকত এবং ছোটো ছোটো বিন্দু দিয়ে তার সংখ্যা উল্লেখ করত। চিত্রভিত্তিক সেই লিপিকে বলা হয় হায়ারোগ্লিফিক। হায়ারোগ্লিফিক নামটি গ্রিকদের দেওয়া। এর অর্থ হচ্ছে, পবিত্র খোদাই কর্ম। চিত্রভিত্তিক লিপি থেকেই তারা ক্রমে ক্রমে অক্ষরভিত্তিক লিখনপদ্ধতি আবিষ্কার করে। লেখার উপকরণ হিসাবে মিশরীয়রা প্যাপিরাস নামক কাগজ এবং কালো কালির আবিষ্কার করেছিল। প্যাপিরাস ছিল মূলত একধরনের নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ। প্যাপিরাসের কাণ্ডকে খুব পাতলা করে কেটে রঙে ডুবিয়ে, রোদে শুকীয়ে লেখার উপযোগী করা হতো।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় সমাজ ও সংস্কৃতি
আনুমানিক ৪০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে কতগুলো নগর সভ্যতার জন্ম হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, এসেরীয়, ফনেশীয় এবং ক্যালডীয় সভ্যতার নাম উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসে এই সভ্যতাগুলোর সমন্বিত নাম মেসোপটেমীয় সভ্যতা। ভূ-পৃষ্ঠের ভিন্ন ভৌগোলিক বাস্তবতায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গড়ে উঠা এই নগর সভ্যতাগুলোতেও মিশরীয় সভ্যতার মতোই শ্রেণিভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছিল। রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাজাদের এই ক্ষমতাকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছিল পুরোহিত বা ধর্মগুরুরা। রাজাকে তারা ক্ষেত্রবিশেষে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। অন্যান্য শ্রেণির মানুষের সামাজিক অবস্থান ছিল অনেক নিচে। সমাজে দাস প্রথার প্রচলন ছিল। ভূমিদাস ও ক্রীতদাসদের অবস্থান ছিল সবচেয়ে নিচের শ্রেণিতে।
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে গড়ে উঠা সভ্যতাগুলোর মধ্যে সুমেরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মেয়েরা সম্পদের অধিকারী হতে পারতো এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার তাঁদের ছিল। অন্যদিকে একই অঞ্চলে গড়ে উঠা এসেরীয় সভ্যতায় মেয়েদের সেই অধিকার ছিল না। ক্যালডীয় সভ্যতায়ও মেয়েদের অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অগ্রদূত বলা হয় সুমেরীয় সভ্যতাকে। ইতিহাসে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ৩০০০ সাধারণ পূর্বাব্দে সুমেরীয়রা কীউনিফর্ম নামের এক ধরনের লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। কাদামাটির নরম প্লেটের ওপর সরু কাঠির অগ্রভাগ দিয়ে অক্ষর ফুটিয়ে তোলা হতো। পরে তা রোদে শুকীয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে সংরক্ষণ করা হতো। সুমেরীয়রা ছিল সাহিত্যপ্রেমি। আনুমানিক ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দে তারা 'গিলগামেশ' নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেছিল। গিলগামেশ কাব্যে মহাপ্লাবন এবং সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্রান্ত এমনঅনেক কিছুই বলা হয়েছে যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়।
সুমেরীয় সভ্যতায় প্রথম চাকাচালিত যানবাহনের প্রচলন হয়। স্থাপত্যক্ষেত্রেও সুমেরীয়দের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। সুমেরীয়দের স্থাপত্যবিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল জিগুরাত নামের ধর্মমন্দির।